বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
হজ্জের পর কী?
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যাঁর নেয়ামতেই সকল সৎকাজসমূহ সম্পন্ন হয়ে থাকে, আর তাঁর দয়াতেই সকল ইবাদাত কবুল হয়ে থাকে। আমরা তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি, আর এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা‘বুদ নেই এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ্ তার উপর, তার পরিবার ও সঙ্গী সাথীদের উপর দুরুদ প্রেরণ করুন এবং বহু পরিমানে সালাম পেশ করুন। তারপর,
হজ্ গত হল, তার কার্যাদি পূর্ণ হলো, আর হজের মাসসমূহ তার কল্যাণ ও বরকত নিয়ে চলে গেল। এ দিনগুলো অতিবাহিত হলো, আর মুসলিমগণ তাতে তাদের হজ সম্পাদন করল, তাদের কেউ আদায় করল ফরয হজ্, অপর কেউ আদায় করল নফল হজ্, তাদের মধ্যে যাদের হজ কবুল হয়েছে তারা তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে নিয়ে এমন দিনের মত প্রত্যাবর্তন করল যেমন তাদের মাতাগণ তাদেরকে জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং সফলকামদের জন্য রয়েছে মুবারকবাদ। যাদের থেকে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে তাদের সৌভাগ্যই সৌভাগ্য!
“আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই কবুল করে থাকেন”।[1]
প্রত্যেক মুসলিমের জানা উচিত যে, নেক আমল কবুল হওয়ার কিছু চিহ্ন ও কিছু নিদর্শন রয়েছে। নেক আমল কবুল হওয়ার অন্যতম চিহ্ন হচ্ছে সে আমলের পরে আবার আমল করতে সমর্থ হওয়া, পক্ষান্তরে সে আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চিহ্ন হচ্ছে, সে আমল করার পর খারাপ কাজ করা।
সুতরাং যখন হাজী সাহেব হজ থেকে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং তাঁর নিজকে দেখতে পাবেন যে তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের প্রতি অগ্রণী, কল্যাণের প্রতি অনুরাগী, দ্বীনের প্রতি দৃঢ়, অপরাধ ও গোনাহ থেকে দূরে অবস্থানকারী, তখন সে যেন বুঝে নেয় যে আল্লাহ চাহেত এটি আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার আমল কবুল হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত।
আর যদি নিজকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে পিছপা দেখতে পায়, কল্যাণের কাজ থেকে বিমুখ, অপরাধের প্রতি প্রত্যাবর্তনকারী ও গোনাহের কাজে অগ্রণী, তবে সে যেন বুঝে নেয় যে, এসব কিছু সঠিকভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবার অবকাশ দিচ্ছে।
হে বাইতুল্লাহর হজকারী, আপনি সে সব সম্মানিত দিনগুলো অতিবাহিত করেছেন, আর পবিত্র স্থানগুলোতে অবস্থান করেছেন, সুতরাং আপনার এ কাজ যেন হিদায়াতের পথ ও হকের রাস্তায় চলার নতুন মোড় হয়ে দেখা দেয়।
হে আল্লাহর আহ্বানে সাড়াদানকারী, আপনি হজে সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে তালবিয়া পাঠ করেছেন এবং ডেকেছেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ সুতরাং সর্বদা প্রতিটি কাজে আল্লাহর জন্য হাজির থাকতে সচেষ্ট থাকুন। তাঁর আনুগত্যে সর্বদা রত থাকুন; কেননা, যিনি হজের মাসের রব, তিনি অন্য মাসেরও রব, আর আমরা আমৃত্যু আল্লাহর কাছে সাহায্য ও একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে নির্দেশিত হয়েছি।
“আর আপনার রবের ইবাদত করুন, যতক্ষণ না আপনার কাছে মৃত্যু আসবে।”[2]
কল্যাণের মওসুম হে মুসলিম ভাই, মানব জীবনের সাময়িক পরিবর্তন নয়; বরং তা খেল-তামাশা অন্যায়-অবিচার ও ত্রুটি-বিচ্যুতির জীবন থেকে আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ আনুগত্য ও তাঁর দাসত্বের দিকে প্রত্যাবর্তন।
কল্যাণের মওসুম এরকম কোন স্টেশনের নাম নয় –যেমনটি কোন কোন মানুষ মনে করে থাকে- যেখানে কোন মানুষ তার ভার লাঘব করবে, তার গোনাহ থেকে পরিত্রাণ নিবে, তারপর সেখান থেকে ফিরে গিয়ে পুণরায় অন্য কোন বোঝা নতুন করে বহন করবে। এটি নিঃসন্দেহে ভুল বুঝা। যারা এ ধরনের কিছু বোঝে তারা অবশ্যই এ মওসুমগুলোর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ভুল করেছে। বরং এ মওসুমগুলো গাফেলদের সাবধান করার সুযোগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকারীদের জন্য উপদেশ; যাতে তারা তাদের গুনাহসমূহ থেকে বিরত হয়ে, তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে, ভবিষ্যতে সেগুলো পরিত্যাগ করার উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়;
“আর নিশ্চয় যারা তাওবাহ করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে তারপর হিদায়াত গ্রহণ করে আমি তাদের জন্য অধিক ক্ষমাশীল।”[3]
অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ তাদের নফসের প্রবঞ্চনা ও শয়তানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়ে থাকে; এমনকি শেষ পর্যন্ত এ অবস্থাতে তাদের মৃত্যু হয়।
সুতরাং হে আল্লাহর ঘরের হজকারী! আপনি তার মত হবেন না যে মজবুত প্রাসাদ নির্মাণ করে সেটার ভিত্তিমুলে আঘাত করে।
“তার মত যে তার সূতা মজবুত করে পাকাবার পর সেটার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়।”[4]
কিছু মারাত্মক বিষয় রয়েছে যার জন্য প্রতিটি মুসলিমের সাবধান হওয়া জরুরী, যেমন কিছু মুসলিম আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হজ করে থাকে, অথচ সে তার চেয়েও বড় বস্তু পরিত্যাগ করে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ ফরয সালাতই আদায় করে না, নিঃসন্দেহে তার হজ হয় না। কারণ সে সালাত পরিত্যাগকারী। আর সালাত পরিত্যাগকারী সম্পর্কে কঠোর সাবধানাবাণী ও ধমকি এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣ ﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٣]
“ ‘তোমাদেরকে কিসে ‘সাকার’-এ নিক্ষেপ করেছে?’ তারা বলবে, ‘আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না”।[5]
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
﴿ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَإِخۡوَٰنُكُمۡ فِي ٱلدِّينِۗ وَنُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ١١ ﴾ [التوبة: ١١]
“অতএব তারা যদি তাওবাহ্ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে দ্বীনের মধ্যে তারা তোমাদের ভাই”।[6]
আরও বলেন,
﴿ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٥ ﴾ [التوبة: ٥]
“কিন্তু যদি তারা তাওবাহ্ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়[7] তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও”।[8]
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« إن بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة»
“নিশ্চয় একজন লোক এবং শির্ক ও কুফরীর মধ্যে সালাত পরিত্যাগ করাই মাপকাঠি।”
ইমাম মুসলিম জাবের রা. থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন[9]।
আর ইমাম তিরমিযী বুরাইদাহ রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر»
“আমাদের মধ্যে ও কাফের-মুশরিকদের মধ্যে অঙ্গীকার হচ্ছে সালাতের; সুতরাং যে তা ত্যাগ করবে সে অবশ্যই কাফের হয়ে গেল”।[10]
তাছাড়া তিরমিযী তার গ্রন্থের কিতাবুল ঈমানে সহীহ সনদে প্রখ্যাত তাবে‘য়ী শাকীক ইবন আবদিল্লাহ রহ. থেকে বর্ণনা করেন,
‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ অন্যান্য আমলের মধ্যে কেবলমাত্র সালাত ত্যাগকরাকেই কুফরি হিসেবে গন্য করতেন’[11]।
তাছাড়া এমন কিছু মানুষও রয়েছে যারা আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হজ করে কিন্তু তারা যাকাত দেয় না; অথচ মহান আল্লাহর কিতাবে যাকাতকে সালাতের সাথে একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে,
“আর তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর”। [12]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمداً رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة فإذا فعلوا ذلك عصموا مني دمائهم وأموالهم إلا بحق الإسلام وحسابهم على الله»
“আমি তো মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশিত হয়েছি যতক্ষণ না তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত হক কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, অতঃপর যখন তারা তা করবে, তখন তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ আমার হাত থেকে নিরাপদ পাবে, তবে ইসলামের অধিকার ব্যাপার ভিন্ন, আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর”।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম ইবন উমর থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন[13]।
আর আবু বকর রা. যাকাত প্রদান করতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তার সে বিখ্যাত বক্তব্যটি প্রদান করেছিলেন,
“আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আমি সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্যকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, আল্লাহর শপথ, যদি তারা আমাকে একটি উটের রশি অথবা উটের বাচ্ছা দিতেও অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিত, তবে অবশ্যই সেটা উদ্ধার করতে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।[14]”
অনুরূপভাবে কিছু মানুষ আছে যারা হজ্ করে কিন্তু রমযানের রোযা রাখেন না, অথচ রোযা হজের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ; রোযা হজের আগে ফরয হয়েছে। এ সমস্ত লোক যারা হজ আদায় করে ইসলামের অন্যান্য রুকন নিয়ে অবহেলা করে তারা যেন এমন শরীরের অঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকে যার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন।
একজন মুসলিমের উপর অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, সে তার দ্বীনের হেফাযত করবে, পূর্ণতার দিকে লক্ষ্য রাখবে, দ্বীনের কোন অংশ ছুটে যাওয়া কিংবা বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপার যত্নবান হবে। সুতরাং সে যাবতীয় ওয়াজিব আদায় করবে, নিষেধকৃত বিষয়াদি পরিত্যাগ করবে, আমৃত্যু আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকবে। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسۡتَقَٰمُواْ تَتَنَزَّلُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُواْ وَلَا تَحۡزَنُواْ وَأَبۡشِرُواْ بِٱلۡجَنَّةِ ٱلَّتِي كُنتُمۡ تُوعَدُونَ ٣٠ ﴾ [فصلت: ٣٠]
“নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ্’, তারপর অবিচলিত থাকে, তাদের কাছে নাযিল হয় ফেরেশ্তা (এ বলে) যে, ‘তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।”[15]
আর হজের পর যে বিষয়টি বেশী গুরুত্বের দাবীদার, তা হচ্ছে একজন মুসলিম তার নিজের বিষয়টি বারবার দেখবে, আত্মসমালোচনা করবে, পূর্বের কৃত আমলের ব্যাপারে নিজের হিসাব নিজে গ্রহণ করবে, তারপর নিজের জন্য এমন এক প্রোগ্রাম স্থাপন করবে যা সে প্রতিপালন করতে পারে, যাতে করে সে হজের মাধ্যমে যে ঘরটি বানিয়েছে তা পূর্ণ রূপ দিতে পারে।
এসব কিছু এ জন্যই যে বান্দা হজের ফরয আদায় করার পর এবং এর জন্য আল্লাহর তাওফীক লাভের পর গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের যথাযথ হেফাযত করবে।
আমি মহান আল্লাহর কাছে কায়োমনোবাক্যে চাই তিনি যেন সবার হজ কবুল করেন এবং তাদের হজ মাবরুর (মাকবুল) করেন, তাদের প্রচেষ্টা সফল করেন এবং তাদের গুনাহ ক্ষমা করেন। আর আমি কথা, কাজে মহান আল্লাহর ইখলাস বা নিষ্ঠা কামনা করি এবং সৃষ্টিকুলের সর্দার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথের উপর চলার তৌফিক কামনা করি। আরও চাই তিনি যেন এ কাজটি দুনিয়ার জীবন ও মৃত্যুর পরে জীবনের জন্য গচ্ছিত আমল হিসেবে গ্রহণ করেন, নিশ্চয় তিনি এর অভিভাবক এবং তা করতে সক্ষম।
আর সালাত ও সালাম রইল আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তার পরিবার ও সকল সাহাবীর প্রতি।